টেকনাফ থেকে ফিরে : মায়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়ীঘর ফেলে এক কাপড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এটা পুরাতন খবর।
দেশের মানুষের সুখ দুঃখের সমাধান করার দায়িত্ব রাজনীতিকদের। বিশেষ করে সরকারের। রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসলামী আন্দোলন মানুষের কল্যাণে যে ‘রাজনীতি’টা করে যাচ্ছে সেটা কিন্তু মোটা দাগের ।
গত মাসের ২৬ তারিখে শুরু হওয়া ত্রাণ তৎপরতার ধরণ ও ব্যাপকতা আরো বাড়িয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। প্রতিদিন ১৫টি স্পটে এই কার্যক্রম চলছে।
১৯ তারিখে ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম হাফিজাহুল্লাহ (পীর সাহেব চরমোনাই) দিনব্যাপী রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোনদের মাঝে জরুরী খাদ্যদ্রব্যের ছোটবস্তা বিতরণ করেন। কয়েকদিনের খোরাকের আইটেম ছিলো তাতে।
তাঁর সফরের গাড়ী বহরে থেকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, তাঁকে পেয়ে রোহিঙ্গারা যেন ভরসা পেয়েছে। তাঁরা একত্রে নামাজ পড়েছে। দুঃখ দুর্দশার কথা বলেছে, যেন তিনি তাঁদের অতি আপনজন ও অভিভাবক।
প্রতিটি স্পটে যখন তিনি কথা বলছিলেন তখন তাঁর গলাটা ধরে এসেছে। কাঁন্নাটা চেপে রাখছিলেন বারবার। আসলে নেতা ও অভিভাবকের কান্না করা মানায়না। একটিই শান্তনা দিয়েছেন তিনি, “সবর করতে হবে। মাওলা পাকই ব্যবস্থা করবেন। ইসলামী আন্দোলন আপনাদের পাশে থেকে যথাসাধ্য সহযোগিতা চালিয়ে যাবে”।
প্রিয় নেতার মুখে এমন অভিভাবকসুলভ কথা শুনে তারা তাকিয়ে থাকে তাঁর মুখের দিকে। কি বলবে, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। তবে কৃতজ্ঞতায় চোখের পানি পড়তে দেখেছি। হয়তো তাদের ভাষার দূর্বোধ্যতার জন্য শায়েখের সামনে খুব বেশী বলছে না।
আর আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা নারী রোহিঙ্গারা কোলের শিশুটা একপাশে, আরেকপাশে যখন ত্রাণের পোটলা নিয়ে ফিরে যায়, তখন চোখের ভাষাটা পড়লে বোঝা যায়, “আজ আমাদের একটি ভালো দিন।” এ দিনটায় আনন্দের কান্নাও করতে দেখেছি অনেককেই।
টেকনাফের কুতুপালং, বালুখালি ও হ্নিলায় আনুষ্ঠানিক ত্রাণ বিতরণকালে পীর সাহেব হুজুর সবাইকে সবর করার পরামর্শ দেন। তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে মুনাজাত করেন। তিনি ঘোষণা দেন, শরণার্থী দুর্দশাগ্রস্ত ভাইদের বেঁচে থাকতে যতটুকু করা সম্ভব সেটা করবে ইসলামী আন্দোলন।
নতুন খবর অনুযায়ী, পরিকল্পনা মতে তাঁদের জন্য অস্থায়ী বাসস্থান নির্মানের কাজে হাত দিয়েছে স্থানীয় জানবাজ নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় নেতা মুফতী দেলওয়ার হোসাইন সাকী ভাই সরেজমিনে উপস্থিত থেকে তা তদারকি করছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে দু’তিন হাজার অস্থায়ী গৃহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পলিথিন, টিন, কাঠ ও বাশ দ্বারা এগুলো তৈরী হবে। পর্যায়ক্রমে তা বিশ হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া টয়েলেট, নলকূপ স্থাপন ও মসজিদ নির্মাণ সমানে চলছে।
রোহিঙ্গাদের ত্রাণকার্যের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিষটি “লঙ্গরখানা” প্রথম শুরু করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ইসলামী আন্দোলন। প্রতিদিন শতশত শত লোকের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে শাহপরী দ্বীপের মেহমানদের। ।
রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে সুন্নত হিসেবে নতুন মেহমান হিসেবেই গণ্য করে ইসলামী আন্দোলন। তাঁরা মুহাজির। আমরা আনসার হিসেবে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে না পারলে মুসলমানিত্বের কোনো মানে নাই। আর এটাই এখন দরকার। এর নামই মানবিকতা। এ মানবিক আন্দোলনে সবার এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতিটা এখন মানবিকতার চুড়ান্ত নমুনায় রূপ নিচ্ছে।
এ দিন পীর সাহেব হুজুর নিজেসহ অপর চারভাই মোট পাঁচভাই ত্রাণ বিতরণে শামিল ছিলেন। সংগঠনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমাদ, ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন সহ কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলগণ হাজির ছিলেন।
হ্নিলায় ত্রাণ বিতরণকালে শোনা গেলো, এক রোহিঙ্গা বয়স্কা মা ইন্তেকাল করেছেন এবং তাঁর জানাজার নামাজ পড়াবেন স্বয়ং পীর সাহেব চরমোনাই। তখন আনমনে বলে ফেলেছি, এ মহান ব্যাক্তিটি আজ রোহিঙ্গাদের জীবন ও মরণের সাথে কতো নিবিড়ভাবেই না জড়িয়ে পড়লেন!
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও ইসলামী গবেষক
Leave a Reply