এম শামসুদদোহা তালুকদার : বর্তমানে যে জটিল ও ব্যাপক সমস্যাটি নিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে, সেটা হলো রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমার সরকারের নৃশংসতার দমননীতি। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যটা ঐতিহাসিক আরাকানেরই পরবর্তিত সরকারী নাম। এ রাজ্যে বসবাসরত মানুষগুলোর প্রায় সকললেই মুসলমান ও বাংলাভাষী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সাথে তাদের কথ্যে অনেক মিল রয়েছে। কষ্টের সাথে বলতে হচ্ছে, রোহিঙ্গা জাতিসত্তাটি আজ বিলুপ্ত হতে চলছে।
আরাকানের নুতন দেয়া নাম রাখাইন রাজ্যটি একসময় স্বাধীন ছিলো। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত স্বাধীন হিসেবেই আরাকানের রাজনৈতিক পরিচয় ছিলো। ১৭৮৪ সালে বার্মিজরা সেটা দখল করে নেয়। তবে ১৮২৬ সালে ইংরেজরা সেটি দখল করে তা পরিচালনা করে আসছিলো। সুলতানী আমলে আরাকান ছিলো বাংলার আশ্রিত রাজ্য। সে সময় জাতীয় মূদ্রায় পবিত্র কলেমা অংকিত থাকতো। আরাকানে কিন্তু ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বাস করারও নজির রয়েছে। অনেকে আবার রাখাইন বা মগদস্যু ওরফে হার্মাদ কর্তৃক অপহৃত হয়ে পরে আরাকানের বাসিন্দা হয়ে যান।
মধ্যযুগের বাংলা কবি মাগন ঠাকুর, আলাওলসহ অনেকেই আরাকান রাজসভায় দায়িত্ব পালন করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের শাসনকালে চাটিগাঁও মুঘলদের অধীনে আসে। মগ জলদস্যুদের অপকর্মের ইতিহাস অনেক লম্বা। চট্টগ্রাম উপকূলে তারা লুটতরাজ চালাতো। সে সময় চট্টগ্রামকে রক্ষা করেন সুবেদার শায়েস্তা খান। এক পর্যায়ে সন্দ্বীপের যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত করেন।
আরাকান মূলতঃ বার্মা অধিকৃত একটি দেশ। এর নাগরিকরা প্রায় হাজার বছরের পুরনো বাসিন্দা। সেকালে মুসলিম লোকসংখ্যা ছিলো মাত্র বাইশ হাজার।
১৯৪৮ সালে বার্মা ইংরেজদের থেকে ভাগ হয়ে গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে আসে। সে সময়ের নির্বাচনগুলোতে রোহিঙ্গারা অংশগ্রহন করেছিলো এবং পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিলো। বার্মার অন্যান্য অংশের নাগরিকদের মতো সমান স্বাধীনতা সে সময় ওখানে বহাল ছিলো। আরাকানের বাসিন্দা রোহিঙ্গা মুসলমান হিসেবে পরিচিত।
১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা নে উইন সে দেশের ক্ষমতা দখল করে নেন। এরপর থেকেই আরাকানের বাসিন্দাদের দূর্ভাগ্য শুরু। নে উইন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে কট্টর জাতীয়বাদের রাজনীতি শুরু করে দেন। তিনি আরকানের নাগরিক রোহিঙ্গাদের সকল মৌলিক অধিকার কেড়ে নেন। বার্মার নাগরিকত্ব বাতিল করে সরকার। তাদের ভোটাধিকারও রহিত করে।ফলে তারা নিম্নশ্রেণীর নাগরিকত্বে পরিণত হয়। ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত করতে যা যা করা দরকার সবই করেছে জান্তা সরকার। রাজধানী আকিয়াবের নামও পরিবর্তন করে সরকার। এর প্রতিবাদ করলে জুলুমনীতির কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মায়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের কোন উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম সে এলাকায় ছিলোনা ফলে দারিদ্রতা ও অশিক্ষার কারণে তারা নিম্নশ্রেণীর অধিকারহারা জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
নে উইনের পরবর্তীতে সরকারগুলোর নীতি অপরিবর্তিত থাকায় রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের কোন হেরফের হয়নি। সারা জাহানের লোক প্রত্যাশা করছিলো, অং সান সুচি ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গারা সৃবিচার পাবে কিন্তু তার শাসনামলেই চলতি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটতে লাগলো ফলে আরাকানবাসীর যুবকরা সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়। তারা গতমাসের ২৫ তারিখে এক যোগে বিভিন্ন থানা ও সেনাবাহিনীর চৌকিতে হামলা চালিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ৯ জনকে হত্যা করে। ২৬শে আগষ্ট থেকে সরকারী বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। হত্যার উৎসব যেন চলছে রাখাইনে। নারী শিশু ও বৃদ্ধবৃদ্ধারাও সমানে নির্মমতার শিকার হন। তাদের হত্যার নিষ্ঠুর ধরন ও কায়দার ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে পড়ায় সারা বিশ্ব এখন নড়ে চড়ে বসেছে। তারা রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর ব্যবসা কেন্দ্র ও সকল স্থাপনা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় মায়ানমার আর্মি ও উগ্র জাতীয়তাবাদী খুনী চক্র।
উপর্যপুরি নির্যাতনের ফলে সীমান্ত অতিক্রম করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। রোহিঙ্গা মুসলিমরা এখন আর আরাকানের কেউ না। তারা এখন নিঃস্ব, স্বজনহারা, বাস্ত্তহারা এক জনগোষ্ঠীর নাম।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে রোহিঙ্গাদেরকে শরণার্থী হিসেবে বরণ করতে প্রথমে রাজী না হলেও পরে সরকার মানবিক নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। খোলা আকাশের নীচে রোহিঙ্গারা আজ বাংলাদেশের অতিথি। তাদের খাবার, থাকার জায়গা ও স্যানিটেশন চাহিদা পূরণ করছে এ সাধারণ মানুষ। সরকারী উদ্যোগ ঢিলেঢালা। তারা এনআইডির আদতে নিবন্ধন করছে।
প্রিয় মুসলিম ভাইবোনদের পাশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ সহায়তা দিলেও একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের লাগাতার ত্রাণ ও নগদ অর্থসহায়তা ঈর্ষণীয়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের নির্দেশে এ মহৎ কার্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন নেতা কর্মীরা।
ইসলামী দলগুলোর দৃশ্যমান রোহিঙ্গাসহায়ক তৎপরতার অগ্রভাগে যাদেরকে দেখা যায়, তন্মধ্যে নিঃসন্দেহে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাদের এ পর্যন্ত ত্যাগ ও খিদমতের তুলনা হয়না।
ঈদের কয়েকদিন পূর্ব থেকে (২৬/৮/১৭) প্রথম পর্যায়ে দলটির যুগ্ম মহাসচিব, বর্ষিয়ান নেতা মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে সাংগঠনিক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, যুব আন্দোলনের সভাপতি কে এক আতিকুর রহমান, শ্রমিক নেতা হারুনুর রশীদ সহ স্থানীয় ছাত্র, যুব আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা ত্রাণ বিতরণ করছিলেন। তাঁরা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে পরিকল্পনা মাফিক দূর্গতদের মাঝে নগদ অর্থ, খাবার ও জরুরী সামগ্রী বিতরণ করেন।
হৃদরোগের জটিলতা নিয়ে এটিএম হেমায়েত হুজুরের পক্ষে বেশীদিন এমন কঠিন মেহনত করা সম্ভব না হওয়ায় ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি। কেএম আতিকুর রহমানও ফিরে আসেন সেন্ট্রাল কর্মসুচি পালনের আঞ্জাম দিতে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে সেন্ট্রাল থেকে রোহিঙ্গাদের নিকট চলে আসেন দলের কেন্দ্রীয় সদস্য, মুফতী দেলোয়ার হোসেন সাকী, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ইসলাম, ছাত্র আন্দোলনের শরিফুল ইসলাম ও কাওসার আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশে পেয়ে উদ্দীপনায় মত্ত হয়ে স্থানীয় নেতা কর্মীরা রোহিঙ্গাদের খেদমতে নিজেদেরকে উজাড় করে দিচ্ছেন। নগদ অর্থ, খাবার ও জরুরী দ্রব্যাদির পাশাপাশি জীবন রক্ষাকারী ঔষধও প্রদান করা হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন তাঁরা।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ছিলো ১১ই সেপ্টেম্বর, ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বের একজন, যুগের রাহবার খ্যাত সিনিয়র নায়েবে আমীর, মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়েজুল করীমের সরব উপস্থিতি। রোহিঙ্গা বন্ধুদের মাঝে তিনি দিনভর নিজ হাতে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। এ সময় কান্নারত রোহিঙ্গাদের শান্তনা দিতে গিয়ে তিনিও অশ্রুসিক্ত হন।
পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেনঃ “রোহিঙ্গাদের এখন মাথা গোঁজার ঠাই নেই, খাবার নেই , গায়ে কাঁদামাখা মলিন মুখগুলো দেখা বড়ই কষ্টের, সহ্য করার মতো নয়। আমরা ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা সাধ্যমতো ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি।”
১৩ তারিখে মায়ানমার দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচীটি ছিলো ঢাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম গণমিছিল। দূতাবাসগামী গণমিছিলটি বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু হয়। মালিবাগ পর্যন্ত গেলে পুলিশ তা জোরপূর্বক থামিয়ে দেয়। সেখান থেকে নেতৃবৃন্দ দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ তরে আসেন।
মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়েজুল করীম সাহেবর ১৩ই সেপ্টেম্বর সকালে মায়ানমার দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে বিমানযোগে ঢাকায় আসেন। বিকালে ফিরতি বিমানে চট্টগ্রামে পৌঁছে যথারীতি তিনি নির্ধারিত মাহফিলে যোগ দিয়েছেন।
দ্বীনের দাঈ ও নিজ তরীকার খলিফা হিসেবে ২৪ ঘন্টাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি ও পীর সাহেব চরমোনাই আজ চরমোনাই তরিকা ও ইসলামী আন্দোলনকে এ দেশের শ্রেষ্ঠ দ্বীনী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ্।
মিছিলপূর্ব সমাবেশে তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বলেনঃ “রক্ত চায় রক্ত, লাশ চায় লাশ আর জুলুম চায় জুলুম।”
১২ই সেপ্টেম্বর সকালে পীর সাহেব চরমোনাই সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম সাহেব পবিত্র হজ্ব থেকে ফিরেন। এবং তিনি মায়ানমার দূতাবাস ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে গণমিছিলের অগ্রভাগে পায়ে হেঁটে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি আগামী ২১শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ অফিস ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেন। প্রয়োজনে আবারো লংমার্চ কর্মসূচীর ডাক দেয়ার বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেন।
১৯শে সেপ্টেম্বর ত্রাণ বিতরণের লক্ষ্যে সরাসরি হাজির থাকার কথা অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিম কমিউনিটিতে।
লেখকঃ কলামিস্ট ও ইসলামী গবেষক
Leave a Reply