শামসুদ্দোহা তালুকদার : আমার তখন কর্মক্ষেত্র পল্টন থানার বিপরীতে একটা ভবনের চতুর্থতলায়। পল্টন থানার কোয়ার্টারে থাকেন আমার এক নিকটাত্মীয় যিনি একজন পুলিশ অফিসার। ৫ মে বিকালে তিনি এলাকায় থাকতে না বলেছিলেন। অফিসের দায়িত্বের চেয়ে যেন বড় দায়িত্ব ছিলো আলেমদের এ মিলনমেলায় শামিল হওয়া।
এ দিন সকালে অফিসে যেতে হয়েছে ফার্মগেটের পর পায়ে হেঁটে। এতো সংখ্যক আলেমদের রাজপথে পদচারনা হয়নি কখনো। তাঁদের সাথে যোগ দিয়ে কখনো ‘আল্লাহু আকবার’ ‘রাসুলের অবমাননাকারীদের বিচার চাই’ অথবা ‘নাস্তিকদের ঠাই নেই এ জমিনে’ প্রভৃতি শ্লোগান তুলে সামনে আগাচ্ছিলাম সবার সাথে। প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে রাস্তার পাশ থেকে অপেক্ষমান খাবার সরবরাহকারীদের থেকে পানি, জুস আর তরমুজের ফালি নিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে পল্টনে যাই। অফিসে পৌছে একটু পর পর জানালা দিয়ে তাকিয়ে সাদা পোষাকধারী আলেমদের হাজিরা দেখি। আবার কলিগদের নিয়ে বের হয়ে পছন্দের খাবার নিয়ে ফিরে এসে মজা করে খেয়ে নেই। একাধিকবার এটা করেছি। বিরিয়ানি, তেহারি, খিচুড়ি কোনটা নয় ?
এদিন ছিলো হেফাজত আহুত অবরোধে কর্মসূচী। ৬ এপ্রিলও অনুরূপ লংমার্চ কর্মসূচির কারণে এখানে গণজমায়েত হয়েছিলো। ৫ মে অবরোধের দিন বিকেলের দিকে মঞ্চের দিকে গিয়েও যেতে পারিনি ভীড়ের ঠেলায়। পল্টন অফিসের কাছে এটা হওয়ায় বাসা থেকেও বারবার সাবধান করা হচ্ছিলো। ওদিকে গিয়ে যেন বিপদে না পড়ি!
অবশ্য হেফাজতের ৬ এপ্রিল লংমার্চ কর্মসূচির দিন বিকেলে বিএনপির কয়েকজন নেতা যারা পাঞ্জাবী পাজামা পরে এসেছিলেন। সিনিয়রদের মধ্যে ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও সাদেক হোসেন খোকা, ফজলুল হক মিলন সহ আরো অনেক জুনিয়র নেতাদেরকে দেখে হেফাজত নেতারা সাদরে মঞ্চে জায়গা করে দিয়ে বক্তৃতা করার সুযোগ করে দিলেন। তাঁরা খালেদা জিয়ার দূত হিসেবে ও দোয়া নিতে এখানে এসেছেন এবং আন্দোলনের সাথে একাত্মতা জানাচ্ছেন, অাপনারা খালেদা জিয়ার সালাম নিন। এমনটাই ছিলো তাঁদের বক্তব্য।
রাস্তায় দেখি শার্টপরা আল্লামা সাঈদী তনয় মাসুদ সাঈদীকে। সে মঞ্চের কথাবার্তা ভীড়ের মাঝেও নিবিড় মনে শোনার চেষ্টা করছিলেন। একত্রে আছরের নামাজ পড়লাম।
এদিন বিকেলে পশ্চিমদিক থেকে অর্থাৎ দৈনিক বাংলা থেকে একজনকে ঘিরে মিছিল আসছিলো । হ্যাঁ, আমার দেখতে ভুল হয়নি তিনি ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়েজুল করীম। তাঁকে মঞ্চ থেকে অভ্যর্থনা জানাতে কাউকে আগাতে দেখলামনা। একপর্যায় তিনি মঞ্চের অদূরে তাঁর সমর্থকদের নিয়ে রাস্তায় বসে পড়লেন! রাস্তার গালিচা হিসেবে তাঁর জন্য তাৎক্ষণিক বরাদ্দ হলো অনুসারীদের হাতে থাকা পত্রিকার কাগজগুলো। বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ তো দুরস্ত! ৫ মে অবরোধের দিন তিনি আবারো ওখানে গেলে এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তেন কি না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
৫ মে’র অবরোধের দিনশেষে আল্লামা বাবুনগরীর কন্ঠে শোনা গেলো আল্লামা শাহ আহমদ শফী না আসা পর্যন্ত তাঁরা শাপলা চত্বরে অবস্থান করবেন। তাঁকে পুলিশ লালবাগে আটকে দেয়ার সংবাদের কারণে উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। এটা শোনার পর থেকে অজানা ভয় ও আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু এটা সত্যি হলো যখন আমার পুলিশ অফিসার বড়ভাই আমার বাসায় তাঁর বোনকে সাবধান করে ফোন দিচ্ছিলেন। আমি যেন ও এলাকায় সন্ধ্যার পর আর না থাকি ! আমি সদলবলে রাস্তায় মাগরিবের নামাজ পরে অফিসে এসে পৌছাই।
অফিসে টিভির সামনে বসে বিভিন্ন চ্যানেলে রিপোর্টারদের রিপোর্ট দেখে সময় কাটালেও একটা অজানা বিপদের আলামত দেখতে পাই। রাত ১০টার দিকে আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে বড়ভাই নিজে আমাকে অফিস থেকে উদ্ধার করে রাস্তার ওপারে তাঁর কোয়ার্টারে নিয়ে যায়। এ সময় নিজেকে একজন ভিআইপি আসামীর মতো মনে হয়েছিলো। কারণ রাস্তায় তখন শত শত রায়ট পুলিশ প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান করছিলো। সবাই তাঁকিয়ে দেখছেন কিন্তু কেউ কিছু বলছেন না তাঁদের সহকর্মী অফিসারের কারণে।
পল্টন থানাটা ছিলো যেন অপারেশনের হেড কোয়ার্টার। জানালা দিয়ে রাস্তা ও থানা এলাকার অবস্থা বুঝতে চাচ্ছিলাম! এমনও গুজব চলছিলো থানা আক্রমন হতে পারে ! ইতিমধ্যে সাইনবোর্ড ভাংগা হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতও নেয়া হচ্ছিলো। শতশত পুলিশের হাতিয়ার শান দিচ্ছিলো কখন গুলির উৎসব শুরু হবে ! টিভি দেখি আর জানালার দিকে বাইরে তাকাই কিন্তু মাঝরাতে বন্ধ হয়ে গেলো টিভির লাইভ সম্প্রচার। দিগন্ত টিভিটায় ভালোই লাইভ করছিলো। সমগ্র এলাকা অন্ধকারে ডুবে গেলো। টিভি থেকে কিছু বোঝার চেয়ে স্থানীয় ভাবে ভালো শোনা যাচ্ছিলো।
গুলির শব্দগুলো যেন বুকে এসে পড়ছিলো প্রচন্ড কষ্ট আর চাপা কান্নার মাঝে মুহুর্মূহু গুলির আওয়াজের সাথে গালাগালির আওয়াজও ভেসে আসছিলো। মাঝে মাঝে টিভিতে অন্ধকারের মাঝে তাঁদের অসহায়ত্বের ফুটেজ দেখছিলাম। রক্তাক্ত ছবি প্রকাশেও বোধ হয় নিষেধাজ্ঞা ছিলো। ঐ রাতে কতজন কিশোর তালেবে এলেম ও তরুন আলেম কাতরাতে কাতরাতে রাজপথটা লাল রক্তে ভিজিয়ে চলে গেলেন সে হিসেবটা আজও জাতি জানেনা। পরে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে এক সাংবাদিক জেলজুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
আলেমদের সাথে এতো অবমাননা করা হচ্ছিলো যেন খাবার আগে বিড়াল ইঁদুরকে নিয়ে যা করে। আলেমদের আত্মমর্যাদা খোয়ানোর রাতটি ছিলো ৫ই মে ২০১৩। সে অপমান ও রক্তঝরানোর রাতটির কথা ভিকটিমদের স্বজনরা কোনদিন ভুলতে পারবে কি ?
বর্তমানের হেফাজত নেতারা অবশ্য তা ভুলতে বসেছেন। আমি হেফাজতের কেউ না। তবে ব্যাপক সংখ্যক আলেমদের বুকে রক্তক্ষরণ চলছে সমানে, এটা বোঝার মতো আইকিউটা আছে। এটা কিসের বিনিময়ে কমবে বা কিউর হবে সে পথ্যও আমার জানা নেই। তবে এতে আলেমরা বিশেষ করে কওমিয়ানরা ৫ মে’র চেতনা থেকে সরে যান নি। এটাই বাস্তবতা। নেতাদের শিক্ষার পাঠ এটি।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
Leave a Reply